এক.
স্কুলে পড়ুয়া সময়ে ফরিদপুরে আমরা শহীদ সুফী স্মৃতি গ্লোলকাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে-র আয়োজন করতাম। এটা ছিলো ৯৫-৯৭ সালের দিকের ঘটনা। ‘ফরিদপুর ক্রিকেট লীগে‘র পর এটাই ছিলো ফরিদপুরে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আয়োজন আর অংশগ্রহনকারী দলের সংখ্যা হিসাবে সবচেয়ে বড় টুর্নামেন্ট। আমাদের এই টুর্নামেন্টে ৩০-৩২ টি দল অংশগ্রহন করতো এবং জাতীয় লীগের অনেক প্লেয়াররাও হায়ারে বিভিন্ন দলের হয়ে খেলতে আসতো। এই টুর্নামেন্টে আমাদের মানে আয়োজনকারী কমিটির দুটি দল থাকতো। একটি হতো টিম A অন্যটি টিম B. আর আয়োজনকারীদের টার্গেটই থাকতো একটি না একটি টিমকে ফাইনালে নিতেই হবে…!
আয়োজক কমিটি হিসাবে তাই আমরা আমাদের খেলায় নিজেদের আম্পেয়ার সিলেক্ট করতাম, এই আম্পায়ারের দায়িত্ব ছিলো যেভাবেই হোক আয়োজক দলকে জিতিয়ে নিয়ে আসতে হবে। ওইসকল খেলায় শুধু আম্পায়ারই না নিজেদের স্পেশাল ট্রেনিং দেওয়া স্কোরার ও থাকতো যার কাজ ছিলো রান চুরি করা।
একবার বাড়াবাড়ি সব কিছুকেই ছাড়িয়ে গেলো। আয়োজক কমিটির একটা খেলায় প্রতিপক্ষ ভালো খেললো, ম্যাচ জয় ছিলো শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার তাদের কাছে। এমন সময় প্রতিপক্ষের মারা একটি বিশাল ছক্কা গ্যালারী বিল্ডিং টপকে রাস্তার নর্দমায় এসে পড়লো। আয়োজক কমিটির ছেলেপেলে সেই বলটি উদ্ধার করতে এসে সেটা নর্দমায় গেড়ে লুকিয়ে ফেললো। এরপর বলা হলো আজ আর খেলা হবে না কারন – বল নেই। মুলত স্টকে বল ছিলো এবং নতুন বলই ছিলো প্রায় ডজনখানেক যা তখন সরিয়ে ফেলা হলো। প্রতিপক্ষ অবাক, তারা বললো – আমরা বল দিচ্ছি ম্যাচটা চালিয়ে নেওয়ার জন্য, প্রতিউত্তরে আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হলো কমিটির বল ছাড়া খেলা হবে না, কিন্তু কমিটির বল ক্লাবে আটকে আছে আর ক্লাবের চাবি যার কাছে সে ফরিদপুরে নেই, বেড়াতে গেছে…!
ভাবা যায়?
আমরা এই টুর্নামেন্টটা আয়োজন করতাম রোজা কে কেন্দ্র করে, তাই প্রতি ম্যাচে শত শত দর্শক উপস্থিত থাকতো। এই দর্শকদের সামনে এই ধরনের নাটক মঞ্চস্ত হয়েছিলো।
ভাবা যায়?
এত বড় টুর্নামেন্টে রান চুরি করার কথা? বল লুকিয়ে ফেলে আয়োজক নিজেদেরই খেলা পন্ড করা?
আজ ভারত-বনাম-বাংলাদেশের বিশ্বকাপ খেলা দেখে আবার মনে হলো – হ্যা যায়, কেননা সময় অতিবাহিত হলেও বেসিক ইন্সটিন্ট মানুষের সহজে চেঞ্জ হয় না। পৃথিবী সেই দিন থেকে অনেক দূর এগিয়ে এসেছে, পরিবর্তিত হয়েছি আমি, আমার চারপাশের জগত। হাজার হাজার বইয়ের লক্ষ লক্ষ পাতায় হয়তো কোটি কোটি বার “সততা” শব্দটি লেখা হয়েছে। কিন্তু পরিবর্তিত হয় নি মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি…!
আজ নিজের চোখে যখন দেখলাম মাহমুদুল্লাহর মারটা ছক্কা হয়েছে, তখন খুব এডামেন্ট ছিলাম।
আগের কয়েকটি ডিসিশন দেখে মন যদিও বলছিলো আউট দিতে পারে……… কিন্তু পরক্ষনেই আবার নিজেকে শুধরালাম। সারা বিশ্ব দেখছে, এটা কোনভাবেই আউট দিতে পারবে না। এত বড় ভুল/অন্যায় করার কোন সাহস ICC র হবে না। আমি ছিলাম পুর্ন কনফিডেন্ট। কিন্তু আউট দিয়ে আমাকে থার্ড আম্পায়ার শুধু আমার ছেলেবেলার ঘটনাটা মনে করিয়েই দিলো না আমার কনফিডেন্সে আঘাত করলো। বুঝিয়ে দিলো, আত্ববিশ্বাস, ওটাও শক্তি দিয়ে কেড়ে নেওয়া যায়। যেমনটা নিয়েছি শর্মার আউটটাকে নো বল বলে। কিংবা একটা সম্ভাব্য এল বি ডাব্লিউ নাকোচ করে দিয়ে…!
দুই.
আমার মনে আছে, আমাদের শহীদ সুফি স্মৃতি টুর্নামেন্টে তাই যেই দলেরই কমিটির টিমের সাথে খেলা পড়তো, তারা শুকনো মুখে খেলতে আসতো। কারন তারা ম্যাচের ফলাফল জানতো, জানতো কোন ভাবেই জিততে পারব না। শুধু নিয়ম রক্ষার ম্যাচ হয়ে উঠতো সেগুলো।
আমি খুবই উদ্দিগ্ন। আমাদের এই দলটি বেশ সম্ভাবনা ময়। উদিয়মান কিছু তরুনেরা আছে যারা কম করে হলেও ১৫ থেকে ২০ বছর দলকে সার্ভিস দিতে পারবে। আর একটা খেলোয়ার যখন টানা ১৫-২০ বছর খেলবে তারা নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের হয় উঠবে। বিগতকয়েক দিন সোশাল মিডিয়ার কল্যানে দেখেছি বাংলাদেশের তরুনেরা কিভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তরুনদের ভিতরে যেটা খুবই বেশি কাজ করে তা হচ্ছে খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত দিয়ে দেওয়া। তামিম ৯৬ করলো তো তাকে মাথায় তুলে নাচানাচি আবার পরক্ষনেই আছড়ে ফেলা। এটা আসলে অনভিজ্ঞতার কারনেই হয়। শুধু বয়সেই নয় নবীনেরা সাধারনত জীবনের মারপ্যাচেও নবীন।
চাপে যেমন মানুষ ভালো করে সত্য কিন্তু সাপোর্টে বা সমর্থনে মানুষ আরো বেশি ভালো করে। এ জন্য দেখা যায় মাঠে দর্শকদের ভুমিকা খেলোয়ারদের উজ্জিবিত করে। মেসি, নেইমাররা তাই দর্শকদের উজ্জিবিত করতে হাত নাড়ে, যেন প্রতিক্রিয়ায় দর্শকেরা তাদের সমর্থন দিয়ে তাদের চালু রাখে রাখে।
আজকের ম্যাচ বুঝিয়ে দিয়েছে শুধু জোড়ে বল করতে পারলে বা ব্যটে জোড়ে মারতে পারলেই ম্যাচের ফলাফল পাওয়া যায় না। ম্যাচ জিততে হলে আরো অনেক বিষয়ে পরিপক্কতা দরকার। কেননা অন্যন্য খেলার মতো ক্রিকেটও এখন খেলা থেকেও অনেক বেশী ব্যবসা। তাই সেই ব্যবসার কন্ট্রোল নিতে সেখানে আছে রাজনীতি। যেই রাজনীতির দর্শন চিরচারিতভাবেই নগ্ন, “জোড় যার মুল্লুক তার”- এর মত।
আসলে এটা খুবই একটা স্বাভাবিক প্রকৃয়া। আমাদের জাতীয় চরিত্রের দিকে তাকালেও একই দৃশ্য দেখা যাবে , শক্তি দেখানো সম্ভব হলে আমাদের নৈতিক বোধ হারায় যায় এইটা আমাদের বৈশিস্ট। আর সত্যি বলতে কি, ভারতের অবস্থানে আমরা থাকলে আমরা আম্পায়ারদের আরও বেশী প্রভাবিত করতাম এই বিষয়ে সন্দেহ নাই।
তাই, আমাদের খেলোয়ারদের কটু কথা না বলে আমাদের ভবিষ্যতের স্বার্থেই তাদের বরন করে নেওয়াই হবে বুদ্ধিমানের লক্ষন। মনে রাখতে হবে, মাঠে তারা খেলেছে তবে খেলেছে আমাদের জন্য, ১৭ কোটি বাংলাদেশীদের জন্য। তারা চেস্টা করেছে ভালো কিছু করার জন্য যেটা সুস্পস্ট ছিলো। তবে খেলার ভুলে আমরা হারিনি বরং রাজনীতিতে আমরা হেরেছি। আর তাই যদি কোন ভুল হয়ে থাকে, হারার গ্লানি থেকে থাকে সেই ভুল ও গ্লানির দায়ভার আমারো/আমাদেরও।
তাই, ধন্যবাদ বাংলাদেশ ক্রিকেটদল, ধন্যবাদ তোমাদের অস্ট্রেলিয়ায় এসে ভালো খেলা উপহার দিয়ে আমাদের গর্বিত করার জন্য।
সময়, ১০ঃ২৬, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া।