জীবনঃ
২০০৩ কিংবা ২০০৪ সালের দিকে হবে। কোন এক ঈদের বন্ধে ভার্সিটির হল থেকে বাসায় এসেছি। ঈদের ঠিক পর পরই ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা। সঙ্গতকারনেই প্রচুর পড়াশুনা সঙ্গে নিয়ে এসেছি…! প্রচুর পড়াশুনা।

বাসায় এসে দেখলাম বাসার পরিবেশ থমথমে। ঠিক মনে পড়ছে না, তবে কোন একটা পারিবারিক সমস্যা চলছিলো তখন। দিনে দিনে সেটা চরম আকার ধারন করলো। এতটাই চরম যে পড়াশুনা সব মাথায় উঠলো। চারিদিকে অস্থির লোকজন আসা যাওয়া করছে, ছোট খাট কিছুতেই চিৎকার হই-হোল্লা হচ্ছে। এমনেতেই আমাদের বাসা ছিলো অনেকটা পারিবারিক হাব, আত্বীয়স্বজনেরা ফ্রিকুয়েন্টলি আমাদের বাসায় আসা যাওয়া করত, এবং তা ছিলো সাডেন, আন নোটিশড। অনেকেই ছিলো এসে মাসের পর মাস থাকতো। (এটা এখন অন্য কোন ফ্যামিলিতে আমি লক্ষ করি না। কিন্তু আমাদের ছোট বেলার একটা বড় সময় কেটেছে বাসায় আত্বীয়দের সাথে।) এই আনাগোনাটা বেড়ে গেলো, বেড়ে গেলো Excitation…।

আমার আব্বা ছিলেন সব কিছুর সেন্টার, সবকিছু মানে পারিবারিক সবকিছু। সবাই আব্বাকে সমীহ করতো। (আমার একটা ফুফাতো ভাগ্নের নাম মেহরাব, ছোট থাকতে কোথাও থেকে সে একদিন শুনেছিলো উপমা হিসাবে যে আব্বাকে সবাই ভয় পায়, কারন সে বাঘ। তাকে কেউ জিজ্ঞাসা করেছিলো বোধহয়, তুমি ভয় পাও না? , তখন সে উত্তর দিয়েছিলো, নানা ভাই হচ্ছে বাঘ আর আমি হচ্ছি সিংহ । আমি নানাভাইকে ভয় পাই না। এরপর থেকে এই কথাটা সে সবাইকে হুঙ্কার দিয়ে বলে বেড়াতো 🙂 )
আব্বা কেন্দ্রে থাকলেও তিনি অনেক সময়েই সমস্যার সমাধান করতে পারতেন না বলে আমার বদ্ধমুল ধারনা ছিলো। বিশেষকরে তখন যে সব সমস্যা হচ্ছিলো তা তিনি সমাধান তো করতেই পারে নি বরং বিষয়গুলো তাকে কেন্দ্র করে আরো গুলিয়ে উঠেছিলো। তবে, ওর থেকে ভালো কিছু করার মত পরিবারে কেউই ছিলো না এটা ও সত্য। যদিও তার এই পারিবারিক প্রবলেমগুলো হ্যান্ডেল করাটা আমার পছন্দ ছিলো না।

এর ভিতরে, এক তো পড়াশুনার চাপ তারপর বাসার ওই পরিবেশে আমি খুবই হতাশ হয়ে গেলাম। পড়তে পারছি না। অথচ সিলেবাস পরে রয়েছে। আমার মনে আছে, আমার সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে চলে যেতে ইচ্ছা করছিলো। একেবারেই ডিটারমাইন্ড ছিলাম, চুলায় যাক পড়াশুনা। দুর…সব বন্ধ…!
ইনফ্যাক্ট, ইয়ার ফাইনাল এক্সাম হচ্ছে বছরের সব সিলেবাসের উপর এক্সাম। আর ওই মুহুর্তে আমি একটা কম্পিটিশনে ছিলাম। এর আগের ইয়ারে আমি ডিপার্টমেন্টের রেকর্ডব্রেকস্‌ মার্ক পেয়ে ফাস্ট হয়েছিলাম। এত বেশি মার্কস্‌ এর আগে কোন ব্যাচের কেউ-ই পায়নি। সো, বিষয়টা ছিলো সেই সন্মান (! huh, it is meaningless to me now…! However,) ধরে রাখা যা অনেকটাই স্বাধীনতা পাওয়া থেকে স্বাধীনতা ধরে রাখা কঠিন এক্সিওমটার মত…!

সেদিনের সেই সন্ধারাতটা এখনো চোখে ভাসে। আমাদের বাসায় একটা ভারী বেশ আরামদায়ক চেয়ার আছে,আমি সেটায় বসে বসে ভাবছি, ভাবছি সব চুলোয় যাক, রাগে দুঃখে কি কি সব ভাবছিলাম যেন। অর্থহীন সব কিছু। সব কিছু অর্থ হীন। তখন হঠাৎ করেই আমার মোবাইল ফোনেটায় টুংটাং করে একটা মেসেজ আসলো।
———কি অদ্ভুদ…! এরপর …হঠাৎ করেই চারপাশটা আবার গুছিয়ে উঠতে শুরু করলো…!

 

সত্যঃ
ডিপার্টমেন্ট আমার দুই ব্যাচ পরে (সম্ভবত, তিন ব্যাচও হতে পারে) একটা মেয়ে পড়তো। এই মেয়েটা সম্ভবত(!) আমাকে একটু বেশিই পছন্দ করতো। সে আমাকে প্রায়শই ফোন দিতো আর অগনিত ম্যাসেজ পাঠাতো। সে আমার নাড়ি নক্ষত্র খুজে বের করার জন্য বিভিন্ন গবেষনা করতো, যা বিভিন্ন সোর্স মারফত তখন আমি জানতে পারতাম। :O
কিন্তু পাত্তা না দেওয়া স্বভাবটা আমার মজ্জাগত। তাছাড়া, বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রাকটিস আছে, ডিপার্টমেন্টের ভালো রেজাল্টধারীদের চারপাশে সবাই ঘুরাঘুরি করে। সেই সুত্রে প্রচুর মেয়েদের দৃষ্টি কাটিয়ে চলাচল করতে করতে একটা অভ্যস্ততা হয়ে উঠেছিলো। এটা প্রায় স্বাভাবিক। ভালো রেজাল্ট যেই মেয়েটা করতো, তার/তাদের দিকেও সব ছেলেরা আকাঙ্কার দৃষ্টিতে কিংবা কৌতুহলের দৃষ্টিতে তাকাতো, হয়তো আমিও তাকাতাম :/ । তবে এই মেয়েটার সাহস ছিলো বেশি, কেননা, ডিপার্টমেন্টের ছোটদের আর যাই হোক, বড়দের সমীহ করেই চলতে হয় সে সুত্রে বড় কাউকে ডিস্টার্ব করা অনেকটাই দুঃসাহসীক কাজ। সে খুবই বীরচিত ভাবে সেই দুঃসাহসীক কাজটা করে যেতো।

সে মাঝে মাঝেই ফোন দিতো কিন্তু ফোনে তার সাথে আমার কথা হয় নি…! যদিও তার অসংখ্য মেসেজ এসে আমার ইনবক্স ভরে উঠতো কিন্তু আমার একটা মেসেজও তার ইনবক্সে কখনো প্রবেশ করে নি। অথচ সে দিনের সেই অর্থহীন সময়টাকে তার একটা মেসেজ আমার ভিতরের জমে থাকা হীনতাকে হঠিয়ে দিয়েছিলো।

রহস্যময় মানুষের মনস্তত্ব। সহজাত কিছু বিষয় আছে যা আমরা অবচেতনভাবেই বহন করি, চাওয়া না চাওয়ার আকাঙ্খা সেখানে কাজ করে না। ঘটনা ঘটতে থাকে তার নিজেস্ব খেয়ালে।

সে দিনের সেই বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। অবাক হয়েছি ভেবে যে কি অজান্তেই মেয়েটির একটা অংশ প্রকৃতি আমার ভিতর ঢুকিয়ে দিয়েছে। এভাবে না হয়ে এমনও তো হতে পারতো, আমি তাকে পছন্দ করে তার আহবানে সাড়া দিতাম, কিংবা তাকে পছন্দ না করে হলেও তার আহবানে সাড়া দিতাম। পরেরটাই তো প্রেম, দেখতে পাই হচ্ছে চারপাশে। চাইলেই তো পারতাম কিছু একটা করে সেই ঘটনাটি যা আমাদের উভয়ের অজান্তেই আমারই ভিতরে অন্যভাবে রিএকট করেছিলো তার জন্য একটু কৃতজ্ঞতা (!) জানাতে। সে নিশ্চয়ই এমন কৃতজ্ঞতা গ্রহন করতো…! হাহ্‌

মেয়েটি শেষের দিকে আমার ডিপার্টমেন্টের টিচারদের স্বরনাপন্ন হয়েছিলো। ডিপার্টমেন্টের টিচাররা তাকে পছন্দ করতো তাই সে সেই সুযোগটা নিয়েছিলো। একদিন চেয়ারম্যান স্যারের বাসায় গিয়েছি, ম্যাডাম আমাকে বিষয়টি নিয়ে বললো। আমি খুবই অপ্রস্তুত আর অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। ম্যাডাম হেসেছিলেন আমার দুরবস্থা দেখে। বলেছিলো …মেয়েটা তো ভালো, তোমাকে অনেক পছন্দ করে। তোমার আবার পছন্দের কেউ আছে নাকি…!

এতকিছুর পরও কোন ভাবেই আমার মনে সে দাগ কাটতে পারে নি। কিন্তু কি অদ্ভুদভাবেই না সে আমার ভিতরে একটা পরিবর্তন এনেছিলো। এটা কেনো হয়েছিলো। নিশ্চয়ই এর ব্যখ্যা আছে। সেই ব্যখ্যার জন্য সময় অপেক্ষা করেনি কিংবা আমার মনে তার অবস্থান তৈরি হয় নি। কেনো হয় নি? এটা কি কোন অহমিকার ফলাফল…! না বোধহয়।

এই মেয়েটা আমাকে আরো একটা জায়গায় কৃতজ্ঞতাবোধে আবদ্ধ করেছিলো। এই ঘটনাটি অবশ্য শোনা। –আমি মাস্টার্সে ফ্যাকাল্টি ফাস্ট হয়েছিলাম। সাধারনত ফাস্ট বয়রা নিজ ডিপার্টমেন্টেই নিয়োগ পায়, এটাই চিরচারিত নিয়ম। তাছাড়া আমার ফ্যাকাল্টি ফাস্ট একটা আলাদা আপিল বেয়ার করে। তারপরও ফ্যাকাল্টি ফাস্ট হবার পরেও আমাকে পলিটিক্যাল কারনে ডিপার্টমেন্টে শিক্ষক হিসেবে নেয় নি শিক্ষকেরা, বরং খুবই কদর্যভাবে দূরে সড়িয়ে দিয়েছিলো। ওই বোর্ডেই মেয়েটি অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছিলো। শুনেছি, কোন এক মিটিং-এ নতুন শিক্ষক হিসেবে তার অনুভুতি জানতে চেয়েছিলো সবাই, তখন সে নাকি বলেছিলো যেখানে ভাইয়ার মত স্টুডেন্ট শিক্ষক হতে পারে নি, সেখানে আমি নিজেকে যোগ্য মনে করি না। এই কথাটুকু কতটুকু সত্য তা আমি জানি না তবে তখন হেরে যাওয়া এক যোদ্ধার জন্য একচিলতে টলটলে শ্রদ্ধা ছিলো অতটুকু কথা, যা যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে যাওয়া এক যোদ্ধাকে উঠে দাড়াতে সাহায্য করেছিলো…! এত কিছুর পর ও এই কৃতজ্ঞতা বোধ কোন ভাবেই ভালোবাসায় পরিনত হয় নি। এতটুকুও নয়। আর সে কোন দিনই জানতে পারে নি এই সব কিছু।

 

জীবনের সমিকরনঃ
অনন্যতা…! হয়তো এত কিছুর কারনেই এই বিষয়টি পেয়েছে অন্যন্যতা। বেচে থাকার জন্য অন্যন্যতা…!  অন্যন্যতা ছাড়া যে বেচে থাকা অসম্ভব। অন্যন্যতা ছাড়া জীবন নিজেই নিজেকে থামিয়ে দেয়, নিজেই হয় নিজের হননকারী।
সেদিন হঠাৎ ই দেখলাম, মেয়েটির হাসব্যন্ড আমার ফেসবুকের একটা স্টাটাস শেয়ার দিলো। মেয়েটি আমার ফেসবুকে না থাকলেও তার হাসব্যন্ড আছে, এবং সে আমার স্টাটাস শেয়ার দিচ্ছে দেখে এই অন্যন্যতাটুকু বুঝতে পেরেছিলাম…! স্টাটাস শেয়ার দেওয়াটা নয় বরং সেটা শেয়ার দেওয়ার মাধ্যমে যে মেসেজ আমার কাছে এসেছিলো তার নামই- পবিত্রতা। এত কিছুর বিনিময়ে এই এতটুকুই আমার সম্বল…! যা আসলেই খুবই সামান্য আর অপ্রচলিত…!

 

মাঝে মাঝে কত কিছু ভাবি। কত্ত কিছু…আমার ভাবনার রেলগাড়ীটা শুধুই ছুটে চলে। মাঝে মাঝে মনে হয় ওই টাইম মেশিন মুভিটার মত যদি একটা টাইম মেশিন বানাতে পারতাম। তাহলে আমি কত্ত কি করতাম। আমার পিছনের কিছু ভুল শুধরে আসতাম। কিছু সমীকরন মিলিয়ে আসতাম। যদি সত্যি পারতাম একটা টাইম মেশিন বানাতে, তাহলে সেই সময়টাতে ফিরে যেতাম যে সময়টিকে বেধে রেখেছে অর্থহীনের এই গানটা, ‘এপিটাফ’। কি ডিভাইন ছিলো সেই দিনগুলো আমার দৃষ্টিতে, ছিলো চকমক করে উঠা এক নতুন দিগন্ত রেখা। কিন্তু সেটা যে আধার কালোর ছটা ছিলো, বুঝতে অনেক সময় লেগে গেলো। ঠিক ওই সময়টায় গিয়ে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, কেন এই গানটা? কেনো এই কথাগুলো, কেনোই বা মুক্ত নয় সব কিছু? কেনই বা আমাকে? আমি তো কিছু করিনি, কি ক্ষতি করেছিলাম আমি তোমার? কেনো এই প্রবঞ্চনা? প্রভু……

 

FB তে মন্তব্য করতে এখানে লিখুন (ব্লগে করতে নিচে) :

12 Responses to রহস্যময় মনস্তত্ত্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

April 2024
S M T W T F S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930