এক.

সময়টা ছিলো স্টুডেন্ট লাইফের শেষের দিকে, ২০০৭ এর শেষার্ধে। একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদিন ফোন পেলাম। আমার চাকুরীর আবেদনের প্রেক্ষিতে তারা আমার একটি ভাইভা নিতে চায়। আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, কখন ফ্রি আছি। সময়টা আমি পরে জানাতে চাইলে ফোনদাতা আমাকে তার পরিচয় দিলেন। পরিচয় থেকে জানতে পারি তিনি একজন শিক্ষক এবং তার পদবী প্রফেসর। তিনি তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটি দিয়ে সময় করে যোগাযোগ করতে বললেন।

পরদিন তাকে ইন্টার্ভিউ দেওয়ার সময়টা জানাতে তার দেওয়া নম্বরে কল দেই। কল দিতেই তার ফোনের ওয়েলকাম টিউনে আমি যারপনা হতভম্ব হয়ে যাই। তার ওয়েলকাম টিউনে গানটি ছিলো গায়ক হাবিবের গান, ‘ভালো বাসবো…বাসবো রে’। এমন টিন এইজ হিপ হপ সং একজন প্রফেসরের মোবাইল ফোনের ওয়েলকাম টিউন…! আমি শুধু হতভম্বই না, কেনো যেন মেনেও নিতে পারছিলাম না। এপয়েন্টমেন্টের টাইম ঠিক করলেও সেখানে ভাইভা দিতে যাবো না ঠিক করলাম। কিন্তু ভাইয়ার পীড়াপীড়ি ও প্রফেসরটিকে দেখার কৌতুহল মেটাবার ইচ্ছায় নির্ধারিত সময়ে অফিসে গিয়ে দেখা করলাম বটে তবে সেখানে জয়েন করলাম না।

দুই.

চাকুরী করার পাশাপাশি হাইয়ার স্টাডিজ অপরটুনিটির খোজে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের নিজের আগ্রহের কথা জানিয়ে মেইল করতাম। একদিন একটা বড় রিপ্লাই পেলাম অস্ট্রেলিয়ার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসপেক্টিভ সুপারভাইজরের কাছ থেকে, পদবীতে তিনি এসোসিয়েট প্রফেসর এবং আমার সিভি দেখে তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। আনন্দিত আমি তার রিসার্স সম্পর্কে আরো খোজ নিতে শুরু করলাম। অনলাইন ঘেটে তার একটা ব্যাক্তিগত সাইট পেলাম। সাইটটা খুলেই তো আমার চক্ষু চড়কগাছ। সাইটের হোমপেজের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে তার একটা ছবি, ছবিটা এমন যে সেখানে সে তার নাকটা ডান হাত দিয়ে বিকটভাবে উচু করে ধরে আছে, আর ক্যাপশনে লেখা আছে, This is how I look like.
হতভম্ব আমি… তার মেসেজের প্রতি উত্তর দিলাম না। তবে সেই চেহারাটা মনে গেথে গেলো।


এডালটারেশন

সময় গড়িয়ে যায়, ২০০৭/০৮ থেকে ২০১৫, অনেকটা সময়। আমার চারপাশটা যেমন পরিবর্তিত হয়েছে, হয়েছি আমিও। স্টুডেন্ট লাইফে যে রাজনীতি অসম্ভব অপছন্দ করতাম, সময়ের প্রয়োজনে রাজনীতিতে নিজেকে কিছুটা ইনভল্ভ করেছি, বিষয়টা বোঝার চেস্টা করেছি। বাংলাদেশকে বুঝতে হলে, বাংলাদেশে ভালো কিছু করতে হলে রাজনীতি বুঝতে হবে এটা একটা সহজ সুত্র। একটা সময়ে নিজের ভিতরে এই রাজনীতির অবর্তমানে নিজের অনেক প্রাপ্য বুঝে পাই নি, ঠকিয়েছে অনেকেই। তাই পুর্নতা পেতে বা একাস্টমড হতে জড়িয়ে পড়েছি। ধীরে ধীরে চিন্তার একটা জগত জুড়ে বসে গিয়েছে, ধর্ম আর রাজনীতি। এগুলোর আনপ্রডাক্টিভ রুপ দেখে ভিতরে বিদ্রোহ জন্ম নিয়েছে। মুক্তির পথ খুজতে গিয়েও ভাবনার জগতের অনেকটাই দখল করে নিয়েছিলো এই ধর্ম আর রাজনীতি।

পিউরিটান সব সময়েই ছিলো। কিন্তু তারপরেও সুক্ষভাবে এডালটারেটেড হয়েছি।

এই সময়টার ভিতরে আমার অনেক পরিবর্তন হয়েছে আমি বুঝতে পারি। ধর্ম রাজনীতি আর দর্শন এগুলো অনেকটা এলোমেলো ভাবে কখনো কখনো রুক্ষভাবে আমার ভিতরে প্রবেশ করেছে। চোখ বন্ধ করলে আমি আমার পরিবর্তন গুলো দেখি, ফেসবুক স্ক্রল করলে অস্থিরতার চিত্র দেখতে পাই।
আমি অবাক হই।

কিন্তু জীবন কখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। সময় যেমন অতীত হয়, বোধও তেমনি হয় অতীত, ব্যাকডেটেড। এই ফেলে যাওয়া বোধ থেকে যে নস্টালজিয়া তৈরি হয় তা বোধহয় একধরনের ফিলোসফি।

আমার ফেলে আসা দিনগুলোর দিকে তাকালে স্বার্থের টানে আমি বিচলিত হই কিন্তু সংস্পর্শগুলো যখন দেখি আমি অবাক হই।
সত্যকে এড়ানো যায় না, পাশ কাটানো যায় না। সত্যকে স্বীকার করে নিতে হয়। আমি স্বীকার করে নিই। কিন্তু সত্য কি, কিভাবেই বা তা সত্য। তা, আমি বুঝি না।

পেট্রিফ্যাকশন

এখন আমার ডিপার্টমেন্টের হেডকে দেখি হাফপ্যান্ট পড়ে একটা বাইক চালিয়ে অফিসে আসে। গুড-ডে ফিদা, ডেভিডের সাথে দেখা হলেই সম্ভাষন জানায়।
অফিস এসিস্টেন্ট মিসেস এলাইনি কোন কারনে অফিসে গেলেই বলে উঠে, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ টুডে, হানি?

ওরিয়েন্টেশন উইকে ভার্সিটির সামনে ফ্রি বেয়ার, শ্যাম্পেইন বিতরন হয় নবাগত স্টুডেন্টদের মাঝে। বছরে একটা পার্টি হয় টোগা পার্টি। টোগা পার্টির ইতিহাস অন্যরকম হলেও পার্টিটা মুলত অপজিট জেন্ডারের মধ্যে ফ্রেন্ডশীপের জন্য ব্যবহৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগ।

হাফপ্যান্ট পড়ে স্কুল প্রধানের অফিসে আসা কিংবা হানি বলে সন্মোধন করাটা ইতঃস্তত করে না আমায়। এরকম পরিবেশে থেকে আমি এখন অভ্যস্ত হয়েছি নাক উচু করে ধরা ছবির বিষয়ে। আমি বুঝতে পারি, এটা একটা সাবলীলতা যা এদের কালচারের সাথে মানানসই।

আমার প্রফেসরের সাথে যখন ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আড্ডা হয়, মাঝে মাঝে বলি আমি আমাদের কথা, আমাদের শিক্ষকতার ধরন। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা রাজনীতি করেন, আবার সেই সুত্রে দেশের রাস্ট্রপতি হন শুনে তিনি অবাক হন, বোধকরি মজাও পান। (তবে বারাক ওবামা যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সেই উদাহরন টেনে তাকে কিছুটা নিবৃত করি।)
বুঝতে পারি এরা অন্যরকম জীবনযাপন করে। খুব সন্তপনে ধর্ম আর রাজনীতিকে পাশ কাটিয়ে চলে। তাই এই বিষয়ে কথপোকথন বেশি দূর এগোয় না।

বাংলাদেশ থেকে আসার সময় ব্যাকস্ট্রিট বয়েজের আমার একটা প্রিয় গান ছিলো ওয়েলকাম টিউনে। সেটার ভাবাবেগ কিংবা প্রেজেন্টেশন হয়তো হাবিবের গানের মত ছিলো না। তবে, আজ বুঝতে পারি আমিও কিন্তু পরিবর্তিত হয়েছিলাম।
এভাবে ক্রমে ক্রমে আমরা সবাই বোধহয় বিভিন্ন রঙ্গে রঞ্জিত হই, আর আপন রঙটি হারিয়ে যায় তাদের মাঝে।

যখন একা থাকি, জীবনের গভীরতম বোধকে আমি অনুভব করতে চেস্টা করি। জোছনার অপুর্ব রুপ আমি দেখতে পাই কিংবা গভীর রাতের নিস্তব্ধতা, কিন্তু গভীরে তা বুঝি আমি অনুভব করতে পারি না। নিদ্রাহীন দীর্ঘ রজনী আমি অপেক্ষা করি, কোন দিন কি পারবো সেই বোধকে স্পর্শ করতে।

নিজেকে বোঝানোর চেস্টা করি, ভাগ্যে যা আছে তা হবেই।

As the Holy Quran says,

Every man’s fate,
we have fastened
on his own neck. (Sura bani israil.)

আমরা কি করবো না করবো সবই পূর্ব নির্ধারিত, তাই মাঝে মাঝে মনে হয় কি হবে চিন্তা করে? মেনে নেওয়াই যেন জীবনের উদ্দেশ্য।
একদা দুর্বিনীত ভেবে যা বাধা দিয়েছিলাম তা আজ আমার জীবনের অংশ, এটাই ছিল অবধারিত নিয়তি। তাই নিয়তির হাতে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে অপেক্ষা করেই ভালো।

আমি অপেক্ষা করি।

Kelvin Grove, Brisbane.

FB তে মন্তব্য করতে এখানে লিখুন (ব্লগে করতে নিচে) :

2 Responses to পেট্রিফাইড লাইফ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

May 2024
S M T W T F S
 1234
567891011
12131415161718
19202122232425
262728293031