বেশ আগের ঘটনা। এখন থেকে প্রায় ১৪/১৫ বছর হবে। আমি তখন কলেজে পড়ি। ওই সময়টায় আমাদের বাসায় অনাত্বীয় একজন মহিলা থাকতেন। তিনি কয়েকমাস ছিলেন আমাদের বাসায়। তাকে ঠিক হাউজমেইড বলা যাবে না তবে সে আম্মাকে বাসার ডমেস্টিক কাজে সাহায্য করতো। যতদুর শুনেছিলাম সে সচ্ছল ফ্যামিলির গৃহিনী ছিলো তবে কোন একটা অজানা কারনে বাসা থেকে পালিয়ে আমাদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলো। মহিলার নাম ছিলো নাসরিন। একটা ছোট্ট বাচ্চা ছিলো তার, নাম ছিলো নাজমুল।
(আমি সাধারনত মানুষের নাম মনে রাখতে পারি না, মাঝে মাঝে প্রত্যহ জীবনের আশেপাশের মানুষের নামও ভুলে যাই কিন্তু এই ঘটনাটা লিখতে গিয়ে খুব অবাক হয়ে লক্ষ করছি আমার অবচেতন মন তাদের নাম স্বরনে রেখেছে। আসলে সেদিন যা ঘটেছিলো তার ব্যাখ্যা আজো আমার কাছে নেই তবে সেই দিনের কথা মনে পড়লে এখনো কিছুটা হলেও মনে ভয়ের সঞ্চার হয়। হয়তবা সেই ভয়ের জায়গা থেকেই ঘটনাগুলোকে মস্তিস্ক পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে সংরক্ষন করেছে। হয়তবা ব্যাখ্যা পাবার অভিপ্রায় থেকেও সংরক্ষন করেছে…!)
সেদিন সন্ধার পর থেকে আমি বাসার ড্রয়িংরুমে দরজা বন্ধ করে লাউড স্পিকারে গান শুনছিলাম। তখন ব্যান্ডের গান পছন্দ করতাম, ম্যাঙ্গনেটিক টেপ রেকোর্ডারে ব্যান্ডেরই কোন গান বাজছিলো। বাসায় তিনটি রুম ছিলো পরপর, একটা রুমের ভিতর দিয়ে আরেকটি রুমে যাওয়া যেত। ড্রয়িং রুমের পরেই ছিলো একটা রুম আর তারপরে ছিলো আব্বু-আম্মুর রুম। মাঝের রুমটায় একটা বড় পালঙ্ক ছিলো, সেই পুরানো দিনের কারুকার্য করা পালঙ্ক। আমার দাদুর ছিলো ওটা।
আমি ড্রইংরুমের দরজাটা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখতে পেলাম রুমটা অন্ধকার আর আমার নোয়া মামা ওই বড় পালঙ্কের এক কর্নারে চুপচাপ গুটিশুটি মেরে বসে আছে। আর আম্মুর রুমে আলো জ্বলছে সেখানে ওই মহিলাটা হাতে একটা বাটি নিয়ে দাড়িয়ে আছে, সম্ভবত বাটির ভিতরে পানি জাতীয় কিছু ছিলো। ক্ষনকালেই মনে হলো যেন সে আমার হঠাৎ আগমনে কিছুটা লজ্জা পেয়েছে।
দেখলাম আব্বু আম্মু তাদের বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে। তাদের বসে থাকার ধরনটা বেশ স্বাভাবিক নয় বলেই আমার মনে হয়েছিলো। কেননা দুজনই কেমন যেন একটা টানটান উত্তেজনায় মেরুদন্ড সোজা করে বসে আছে। আমি মামাকে জিজ্ঞাসা করলাম, বিষয়টা কি? মামা লাজুক হেসে বললো, ওই মেয়েটা নাকি জ্বীন এর সাথে যোগাযোগ করতে পারে, তো সেটা পরীক্ষা করা হচ্ছে। শুনেই আমি হে হে করে হেসে দিলাম। তখন আমার ‘ডোন্ট কেয়ার’ শেখার বয়স চলছিলো উপোরন্তু ব্যান্ডের গানের প্রভাবেই হবে হয়তো, বিষয়টা নিয়ে মামাকে বেশ উপহাস করলাম এবং হাসাহাসি করতে করতে আবার ড্রয়িং রুমে ফিরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে গানের ভলিউম আরো বাড়িয়ে দিলাম। ড্রয়িং রুমে ফিরে মনে হলো, একুশ শতকে বসে এরা এই সব কি করছে…! বোধকরি এদের আরো দু-কথা শুনিয়ে দেওয়াই আমার কর্তব্য। এই ভেবে দরজা খুলে মাঝের রুমে ঢুকতেই ঘটনাটি ঘটলো।
এই রুমটাই বাসার সবচেয়ে বড় রুম, রুমের একপাশে বড় সেই পালঙ্ক। দরজা খুলে হেটে রুমের মাঝখানে গিয়ে মামার সাথে কথা বলতে শুরু করেছি ঠিক তখনই পরপর তিনটি বন্ধ জানালায় ধাপ ধাপ করে বাইরে থেকে ধাক্কা দিলো কেউ, বেশ দূরে দূরে জানালা গুলোর অবস্থান কিন্তু যেন এক সেকেন্ডেরও কম সময়ের ব্যবধানে বন্ধ জানালা গুলোয় কেউ নক করলো। ওই জানালাগুলোর পরেই পরের ঘরের একটা দরজা ছিলো যেখানে ওই মহিলাটা দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছিলো দেখলাম সে হঠাৎ করেই কাটা কলাগাছের মত পড়ে গেলো। এই ঘটনা গুলো চোখের নিমিষেই ঘটলো, আর কিছু বুঝে উঠার আগেই তীব্র একটা ভয় আচ্ছন্ন করে ফেললো আমাকে। ভয়টা এতটাই স্বতস্ফুর্ত ছিলো আমি লাফ দিয়ে পালঙ্কে উঠে মামাকে জড়িয়ে ধরলাম, মামাও বেশ ভয় পেয়ে আমাকে আকড়ে ধরলো। ভয়টা ক্ষনিকের জন্য হলেও প্রচন্ড ছিলো, আমি রক্তের প্রতি কণিকায় তাকে অনুভব করেছি।
ভয়টা যেমন হঠাৎ করেই এসেছিলো, আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় কাপিয়ে দিয়ে আবার ঠিক তেমনিই চলে গেলো। স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। পাশের রুমে দৌড়ে গিয়ে দেখলাম মহিলাটি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তার দাতে দাত লেগে আছে, আম্মা একটা চামিচ দিয়ে সেটা ছাড়ানোর চেস্টা করছে আর মুখে পানি দিচ্ছে।
শুকনো মুখে ড্রইংরুমে ফিরে এসে চিন্তা করতে থাকলাম। হলোটা কি…! বাসার গেট বন্ধকরা, বাইরে তো কেউ নেই। তাছাড়া এই মহিলা নিজেই আত্মগোপনে আছে, তাই তাকে এই কাজে সাহায্য করারই বা কে আছে যাকে দিয়ে সে বাইরে জানালায় নক করাবে। তাছাড়া দূরে দূরে থাকা জানালাগুলোতে নকগুলোও এত দ্রুত হয়েছে যা কোন মানুষেরই পক্ষেই এত অল্পসময়ে সম্ভব নয়। আর ভয়টা? আমি তো খুবই ফ্রি মুডে ছিলাম, অবিশ্বাসী আত্মবিশ্বাস ছিলো বলা যায়…! ইনফ্যাক্ট ঘটনাটা ঘটার পরেও এখন বেশ স্বাভাবিকই। কিন্তু প্রচন্ড ভয় কেন হঠাৎ ই আচ্ছন্ন করেছিলো। বসে বসে ভাবছিলাম।
কিছুক্ষনপর মামা ড্রয়িংরুমে আসতেই মামার দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা হাসি দিলাম, আর অপেক্ষা করতে লাগলাম কিছুক্ষন আগে তাকে উপহাস করার পর আবার আমার নাজেহাল অবস্থা দেখে এখন বুঝি তিনি তা মিটিয়ে নেবেন…!
…দেখলাম তিনি তা না করে আমার পাশে এসে বসলেন এবং বললেন- তিনিই আব্বা আম্মাকে কনভিন্স করেছিলেন যেন তারা ওই মহিলাকে বোঝায় আর যদি সে কিছু জেনে থাকে তা জানায়। কেননা এর আগে কোন একদিন মামা কোন কারন ছাড়াই রাতে এরকম প্রচন্ড ভয় পেয়েছিলো, আর কোন এক প্রসঙ্গে ওই মহিলা কোন একদিন বলেছিলো তার সাথে জ্বীন-এর যোগাযোগ আছে…! ঘটনাটা শোনার পর আমার গা দিয়ে একটা শীতল স্রোত যেন বয়ে গেলো।
ব্যাখ্যাতিত অনেক ঘটনা আছে যা আমাদের চারপাশে ঘটছে। অতিপ্রকৃত এক জগৎ যা কেউ কেউ অনুভব করছে কিন্তু বেশিভাগ মানুষই তা অনুভব করতে পারছে না। আমার জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার ব্যাখ্যা আমি বিভিন্ন ভাবে দেওয়ার চেস্টা করেছি। কিন্তু কোন ব্যাখ্যাই আমার চেতনাকে সন্তুস্ট করতে পারে নি। তাই তো সেই ঘটনা অন্যন্য অনেক ঘটনার মত মন থেকে হারিয়ে যায় নি, বরং এখনো ক্ষনকাল আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার মত তা জীবন্ত আর সতেজ।
.
.
.
পুনশ্চঃ এই ঘটনাটার সাথে সম্পর্কিত দুইজন মানুষ আজ আমার সাথে নেই, আমার আব্বা এবং আমার মামা। দু জনই হারিয়ে গেছেন। কোথায় হারিয়ে গেছেন? এই হারিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যাও তো আমাদের জানা নেই। যে লোকটার ভ্রুনতে আমার সৃস্টি, যে আমাকে এই পৃথিবীটাকে দেখিয়েছে , চিনিয়েছে সে নেই। জাস্ট হারিয়ে গেলো…! মৃত্যু নিয়ে যে ব্যাখ্যা আমরা দেই সেই ব্যাখ্যায় যে ফাকা আছে তা আমরা জানি। কেননা, শরীরের পতন ঘটলেও অস্তিত্ব যে শরীরের ভিতর অন্যকিছু তা আমরা দেখতে না পারলেও বুঝতে পারি। এই দেখা কিংবা না দেখার আন্তঃযোগের ভিতরেই বোধকরি বিশ্বাসের জন্ম আর তার বসবাস। ..(২১শে মে, ২০১৫, ব্রিসবেন).