এক.
এইচএসসি ফাস্ট ইয়ারে অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ডেঙ্গু টাইপ কিছু হয়েছিলো…! ডেঙ্গু টাইপ কিছু অথবা টাইফয়েড, ঠিক মনে নেই তবে মনে আছে ভীষনরকমের অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। বেড রেস্টে থাকবার কারনে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিলাম।
ফরিদপুরে এইসএসসি লেভেলে ম্যাথ পড়াতো আসাদ স্যার। স্যার খুবই জনপ্রিয় ছিলো, দলবেধে সবাই স্যারের কাছে ব্যাচে পড়তে যেতাম। অসুস্থতার কারনে আমি ওনার ব্যাচ মিস করলাম। হালকা সুস্থ হয়ে একদিন স্যারের কাছে গেলাম, স্যার ম্যাথ আপনার কাছে না পড়তে পারলে তো বিপদ হয়ে যাবে 🙁 । স্যার অনেক ভেবে দেখলো, বললো, সাত সকালে একটা ব্যাচ আছে সবে শুরু হয়েছে সেখানে আমি শুরু করতে পারি। তবে সমস্যা হচ্ছে, ওই ব্যাচের সবাই-ই মেয়ে…! মনে আছে, কথাটা বলে স্যার নিজেই মাথা চুলকাচ্ছিলো।। (স্যারের এইটা ইচ্ছা ম্যানারিজম ছিলো, মজা করে মাথা চুলকাতো 🙂 ) আমি তো মহা চিন্তায় পড়ে গেলাম।। লে বাবা। সব্বাই মেয়ে।।
সমস্যায় তো পড়ে গেলাম, ১৬-১৭ টা মেয়ের মধ্যে একা…। তবে এই সমস্যা থেকে আমাকে উদ্ধার করলো আমার বন্ধু লাইট, খাইরুজ্জামান লাইট। He is a genius dude, generous to me once always :).
সব শুনে ও বললো ব্যাপার না, আমি আমার ব্যাচ চেঞ্জ করে তোর সাথে পড়তে যাব। ওকে নিয়ে স্যারের কাছে গেলাম, স্যার হেসে বললো ভালোই হলো, একজন বসবে আমার ডানে, আরেক জন বায়ে। 🙂

দুই.
আসাদ স্যারের কাছে পড়তে আসতো বিভিন্ন কলেজের স্টুডেন্টরা। আমাদের কলেজ বয়েজ ছিলো, আমার ব্যাচে যারা পড়তো তাদের অধিকাংশই সারদা সুন্দরী মহিলা কলেজের ছিলো। প্রথমদিন পড়তে গিয়ে বুঝলাম মাথায় কিছু ঢুকছে না। এক তো দেরী করে শুরু করেছি, আর দ্বিতীয়ত অসস্তিকর পরিবেশ…! অসস্তিকর এই অর্থে যে কিছু হলেই ওরা হাউকাউ করে, আর স্যার চুপচাপ শুনে যায়।
প্রথম দিন সবার বেজায় আপত্তি…! রাখঢাক ছাড়াই চিল্লাপাল্লা শুরু করে দিলো। তারপর স্যারের মুখে আমার করুন দশার (!) ইতিহাস শুনে না কি যেন এক কারনে ওরা আমাকে আর লাইটকে ওদের ব্যাচে ঠাই দেবার অনুমতি দিলো।। মনে মনে ভাবলাম, যাক গতি তো হলো, আগে শুরু করি এরপর ব্যাচ চেঞ্জ করা যাবেখন :).
>নামটা ঠিক মনে নেই, স দিয়ে তার নাম, সাবরিনা বা এমন কিছু ছিলো, দ্বিতীয় দিন-ই এসে আমায় জেরা শুরু করলো।
-বাসা কই?
–ঝিলটুলি।
-কি জ্বর হয়েছিলো।
–ডেঙ্গু
(শুনে ভয় পেয়ে সেদিনের মত রেহাই দিলো। 🙂 )
এরপর কোন কারনে স্যার দেরী করে আসলে তার জেরা শুরু হয়ে যেতো,
-কয় ভাই বোন?
–৩
-তোমার পজিশন কি?
-আমি ছোট, বড় ভাই, তারপর বোন।
-বড় ভাই কি করে?
–পড়াশুনা করে।
-কি পড়ে?
–মোটা মোটা বই পড়ে (বিরক্ত আমি)।
-বইএর কি নাম নাই?
–মাইক্রো ইকোনমিক্স
-ও ব্যষ্টিক অর্থনীতি, (গম্ভীর গলায়), ইকোনমিক্স তো ভালো সাবজেক্ট।
(সত্যি বলতে কি, মাইক্রো ইকোনমিস্কের বাংলা যে ব্যষ্টিক অর্থনীতি, ওই প্রথম জেনেছিলাম তাই এখনো মনে আছে।)
মাঝে মাঝেই ও এসে জেরা শুরু করতো। লাইট সেভ করার চেষ্টা করতো, তবে লাইট তো ছার, স্বয়ং স্যার-ও ওকে একটু সমঝে চলতো বলেই আমার মনে হতো। ভেরি সার্প, আর বোধহয় একটু ঝগড়াটে এপ্রোচ। মজার ব্যাপারটা কি, ও ফুল ভেইন এ থাকতো মানে কমপ্লিট বোরকা পড়তো। আমরা(লাইট আর আমি) কখনো ওর ফেস দেখিনি…!

লাইটের বাসা স্যারের বাসার কাছেই ছিলো, তবে ব্যাচ পড়া শেষে প্রথম প্রথম কয়েকদিন লাইট হেটে হেটে আমাকে অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে যেতো। তবে এরপরই লক্ষ করলাম ব্যাপারটা। 🙂
অলক নামের একটা ছিপছিপে মেয়ে ছিলো। ও ঢাকায় পড়াশুনা করতো তবে কোন এক কারনে এইচএসসি ফরিদপুরে করছিলো। মেয়েটা জীবনের একটা পার্ট ইংল্যান্ডে কাটিয়েছিলো বিধায় ওর ইংলিশ দারুন ছিলো। লাইটেরও বিদেশ বিভুয়ের প্রতি অসীম টান ছিলো (এই কারনেই কিনা, ও ৩০/৩২ টা কান্ট্রি ঘুরে ফেলেছে, ভু-স্বর্গ সুইজারল্যান্ডের সিটিজেনশীপ নিয়ে ওখানেই জমে গিয়েছে।)
যাইহোক, দেখলাম দুপ করে লাইট ওর সাথে ফ্রেন্ডশীপ করে ফেললো। লে বাবা, লাইট আমাকে এগিয়ে দিতে যায় বটে তবে আমি হাটি ওদের থেকে ৫ হাত দূরে। একদিন আবার অলক এসে আমার ভুয়সী প্রশংসা করে গেলো, দেখছো, ও কত্ত ভালো, আমাদের প্রাইভেট কথার সময় দূরে দূরে থাকে…! 😯 🙄 😈 (গরররররররর্‌)

তিন.
আসাদ স্যার সিটি কলেজের শিক্ষক ছিলেন। সিটি কলেজটা বেসরকারী আর ছোট ছিলো। তবে উনি ফরিদপুরের সব কলেজের স্টুডেন্ট পড়াতেন। বোধকরি পুরো সিটি কলেজে যত স্টুডেন্ট ছিলো আসাদ স্যারের কাছে তার থেকেও বেশি স্টুডেন্ট পড়তো।
স্যার শুধু-ই ভালো পড়াতেন না, বেশ অরগানাইজড ছিলেন। উনি তার সকল ব্যাচের স্টুডেন্ডদের নিয়ে একটা সমন্বিত পরীক্ষা নিতেন। এই পরীক্ষাটা বেশ ঘটা করে হতো। যেহেতু প্রচুর স্টুডেন্ট ছিলো, পরীক্ষাটা সিটি কলেজে হতো। আমাদেরটা ও হয়েছিলো। সিটি কলেজের অন্যন্য টিচাররা আসতেন ইনভিজিলেশোন দিতে।
পরীক্ষার দিনটার কথা এখনো চোখে ভাসে। সিটি কলেজে গিয়ে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এত্ত ছেলেপেলে পরীক্ষা দেবে…! স্যারকে দেখেও আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম, স্যার স্যুট টাই পড়ে এসেছেন। হা হা স্যারকে লুঙ্গী পরা দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম কিনা…LOL..!
যথারীতি পরীক্ষা দিতে বসলাম। পরীক্ষা দিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম, সাইকেলটা কিভাব উদ্ধার করব। তখন সাইকেল চালানো বা চালিয়ে পড়তে যাওয়া বেশ একটা রীতি ছিলো। প্রায় সব স্টূডেন্টদের একটা সাইকেল থাকতো। সবাই সাইকেল নিয়ে এসেছিলো তাই সাইকেলের একটা স্তুপে আমার সাইকেলটা আটকা পড়েছিলো :/ ।
পরীক্ষা দিয়ে সাইকেল উদ্ধার করে চলে আসলাম।
ছেলেপেলেদের কাছে জানতে পারলাম স্যার আগামী পরশু দিন বিকালে তার বাসায় যেতে বলেছে সবাইকে, রেজাল্ট জানাবে। এ বিষয়ে আমার তেমন কোন কেয়ার নেই, আমার দৃষ্টিতে এক্সাইটিং পার্টটা চলে গিয়েছিলো। আর সেটা হচ্ছে, সবার সাথে পরীক্ষা দেওয়া।।

সেদিন বিকালে যেতে দেরী হয়ে গিয়েছিলো, দূর থেকে দেখতে পেলাম স্যারের বাসার সামনে অনেক স্টুডেন্ট, বেশ হৈ চৈ পরিবেশ। মাথা নিচু করে ঢুকতে গিয়ে দেখি সবাই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, পিঠে থাবড়া দিয়ে বলছে এই যে ফিদা আসছে। অনেককেই চিনি না, কিন্তু তারাও হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে,বিষয়টা কি?
স্যার হাসিমুখে এগিয়ে এসে বললো তুই দেরী করে ফেলেছিস্‌। আমি বললাম সরি স্যার।
স্যার বললো তোর পুরস্কারটা তো কে যেনো নিয়ে গেলো, দেখ্‌ তো পাওয়া যায় কিনা। আমি অবাক হয়ে বললাম কিসের পুরস্কার স্যার? স্যার বললো, তুই তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছিস, মাত্র ১ মার্কস্‌ কম পেয়েছিস প্রথম থেকে, হাফ মার্কস্‌ ২য় থেকে।
খুব অবাক হয়ে ছিলাম। স্যার তিনজন কে পুরস্কিত করেছিলো। আমি ভাবিনি তিন জনের মধ্যে আসব, আমি তো পরীক্ষার হলে আমার সাইকেল নিয়েই চিন্তিত ছিলাম…!
স্যার হাক্‌ দিয়ে বললো, ওরে কে আছিস নিয়ে আয় ওটা। (স্যার, এই বাক্যটাও মাঝে মাঝে বেশ মজা করে বলতো, ওরে কে আছিস…! 🙂 )
এরপর সবার সামনে স্যার আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, তোরা দেখে নিস্‌ ফিদা একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে। আমি আনন্দিত হয়েছিলাম, সবার সামনে স্যার আমাকে প্রশংসা করছেন তবে অবাক হয়েছিলাম কেননা স্যার বলেছেন, ফিদা একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরবে এটা শুনে। :/ মাত্র এতটুকু…!
[এটা যেন সেই জোকসটা, এই আধুনিক সময়ে পুরনো দিনে পরে থাকা ভিক্কুকের ভিক্ষা প্রাপ্তিতে খুশি হয়ে ভিক্ষাদাতাকে (এক জন কোটিপতিকে) দোয়া করা, হায় আল্লা, এই ভালো লোকটার ধনসম্পদ তুমি আরো বাড়িয়ে দাও, তাকে তুমি লাক্ষপতি বানিয়ে দাও, টাইপ 😀 (থমকে গিয়েছিলাম কেননা, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো এটা কনফিডেন্স ছিলো, এইম ছিলো ভালো সাবজেক্ট আর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়)। ]
তবে স্যার যে অন্তরের অন্তস্থল থেকে করেছিলেন তা তার চোখ দেখে বুঝেছিলাম। ভীষন ভালো লেগেছিলো, ব্যাচ দেরীতে শুরু করেও এগিয়ে যাওয়ায়।
এরপর কোত্থেকে যেনো লাইট এসে হাজির হলো, সম্ভবত ওই আমার প্রাইজটা গায়েব করে দিয়েছিলো। :/ 🙂

পুনশ্চ ১: আমাদের কলেজের অবস্থা ওই বছর খুবই খারাপ ছিলো। সম্ভবত স্বরনকালের সবচেয়ে খারাপ ছিলো। হতে গোনা কয়েকজন আমরা পাবলিকে চান্স পেয়েছিলাম। আর বাদ বাকী সবাই প্রাইভেটে ভর্তি হয়েছিলো। স্বয়ং লাইটও প্রাইভেটে ভর্তি হয়েছিলো।
পুনশ্চ ২: আসাদ স্যারের পরীক্ষায় প্রথম তিনজনের ভিতরে স্থান পাওয়া আমাকে নির্মল আনন্দ দিয়েছিলো যা আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হয়েও পাই নি…! কেননা, প্রথম শ্রেনীতে প্রথম হওয়াটা অনেকটা প্রতিযোগিতা পুর্ন আর আকাঙ্কার ভিতর ছিলো, কিন্তু স্যারের ওই পরীক্ষার ফলাফল ছিলো অনেকটাই অপ্রত্যাশিত যা আমাকে অনারেবল করেছিলো। ধন্যবাদ স্যার আপনাকে, ছোট একটা মানুষকে বড় কিছুর ছোয়া দেওয়ায়, অনেক ধন্যবাদ।
(রাত ৩:৩৭, ডরম)

By the way, you may find this music soothing 🙂

FB তে মন্তব্য করতে এখানে লিখুন (ব্লগে করতে নিচে) :

6 Responses to যখন ছিলাম HSC পড়ুয়া, ব্যাচে পড়তে গিয়ে বিপত্তি ও আসাদ স্যার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

April 2024
S M T W T F S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930